এবার ঢাকা থেকে কলকাতায় যেতে চায় এমভি রাজারহাট-সি
সাত দশক পর ২০১৯ সালে ঢাকা-কলকাতা নৌপথে (রুট) সরকারি উদ্যোগে পর্যটকবাহী জাহাজ চালু হয়েছিল, তবে লাভজনক না হওয়ায় একই বছরের মার্চে ‘এমভি মধুমতি’ নামের জাহাজটিকে প্রথম ভ্রমণ শেষে গুটিয়ে নেওয়া হয়। এই নৌপথে এখন পর্যটকবাহী জাহাজ চালু করতে চায় এম কে শিপিং লাইনস নামের একটি বেসরকারি কোম্পানি। এরই মধ্যে অনুমতি চেয়ে কোম্পানিটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
এম কে শিপিং লাইনস অনুমোদন পেলে আন্তর্জাতিক রুটে বেসরকারিভাবে দেশের প্রথম পর্যটকবাহী জাহাজ পরিচালনার ঘটনা হবে এটি। আগামী নভেম্বর থেকে ‘এমভি রাজারহাট-সি’ নামের জাহাজটি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতায়াতের জন্য এটি প্রস্তুত। এম কে শিপিং কর্তৃপক্ষ বলছে, সফল হলে ঢাকা থেকে কলকাতায় নিয়মিত পর্যটকবাহী জাহাজটি পরিচালনা করা হবে।
তবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারিভাবে ঢাকা থেকে কলকাতায় পর্যটকবাহী জাহাজ পরিচালনার প্রথম অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অনেক পর্যটক তখন সেবা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দ্বিতীয়বার যাতে একই ভুল না হয়, সে জন্য এবার মন্ত্রণালয় বেশ সতর্ক। ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেদিক বেশি নজর রাখা হচ্ছে।
২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘এমভি মধুমতি’ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) বহরে যুক্ত হয় ২০১৫ সালে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন বলছে, শুরু থেকেই জাহাজটি লোকসান দিয়ে আসছে। ৭৬ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজটি নির্মাণ করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড।
বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল চুক্তির আওতায় ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে এমভি মধুমতি। সেটিই ছিল প্রথম ও শেষ ভ্রমণ। অথচ কথা ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নিয়মিত ঢাকা-কলকাতা নৌপথে যাত্রী পরিবহন করবে জাহাজটি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একসময় নিয়মিত জাহাজ চলত। ১৮৭৪ সালে এই নৌপথে প্রথম বাষ্পচালিত জাহাজে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। সড়ক-রেলপথের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় নৌপথের সেবা। প্রায় ৭০ বছর পর ২০১৯ সালে এই নৌপথে আবার যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ১৯৭২ সালে নৌ প্রটোকল ‘প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড বিটউইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ সই হয়। এর আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের নৌপথ ব্যবহার করে দুই দেশের যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে। যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর কর্মপন্থা বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এওপি) সই হয়।
এরপর এখন পর্যন্ত পাঁচটি ভারতীয় জাহাজ বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। সবশেষ এ বছরের মার্চে এসেছিল ‘গঙ্গা বিলাস’। ৫১ দিনের দীর্ঘ যাত্রায় ওই জাহাজে ভ্রমণ করেছেন ২৮ জন পর্যটক। আর বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিল এমভি মধুমতি। তবে লোকসানের মুখে পড়ে জাহাজটি আর কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করেনি। চার বছর ধরে জাহাজটি সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বেশ দূরে বাদামতলীতে নোঙর করে রাখা হয়েছে।
এমভি মধুমতি কেন নিয়মিত চালানো যায়নি, তা জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এমভি মধুমতির প্রথম ভ্রমণে যত টাকা খরচ হয়েছে, তত টাকা উঠে আসেনি। পর্যটকও কম ছিল। তিনি বলেন, ঢাকা-কলকাতা নৌপথে এ সেবা নিয়মিত করতে গেলে খরচ উঠে আসবে না। সে কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সব ঠিক থাকলে অনুমোদন
ঢাকা থেকে কলকাতায় যাত্রীবাহী জাহাজ চালু করতে গত জুলাইয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দেয় এম কে শিপিং। এতে বলা হয়, এমভি রাজারহাট-সি জাহাজটির ধারণক্ষমতা ৩০০ থেকে ৩৫০ জনের। যাত্রীদের সুবিধামতো সদরঘাট অথবা নারায়ণগঞ্জের পাগলায় ভিআইপি ঘাট মেরি অ্যান্ডারসন থেকে জাহাজ ছাড়া হবে।
কোম্পানিটি বলছে, ভ্রমণের প্যাকেজ হবে ৯ দিনের। জাহাজে সব ধরনের সুবিধা থাকবে। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকবেন। কেবিন ভাড়া ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। তবে পুরো প্যাকেজে খরচ কত পড়বে, তা পরে জানানো হবে। পর্যটকের পাশাপাশি চিকিৎসার জন্যও কেউ চাইলে যেতে পারবেন।
এম কে শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল খান প্রথম আলোকে বলেন, নৌপথে ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার অনেক চাহিদা রয়েছে। যাওয়ার পথে সুন্দরবনে অবস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যটকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে অত্যাধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রেখে জাহাজটি তৈরি করা হয়েছে। অনুমতি পেলে বাণিজ্যিকভাবে এটি নিয়মিত চালানো হবে।
চিলমারী বন্দর ছেড়েছে দীর্ঘ যাত্রার প্রমোদতরি ‘গঙ্গা বিলাস’
ঢাকা থেকে কলকাতা জাহাজ চালু নিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। নৌসচিব মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে হওয়া ওঠে বৈঠকে উপস্থিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা ইতিবাচক মতামত দেন। তবে ২০১৯ সালে এমভি মধুমতির অভিজ্ঞতার বিষয়টি বৈঠকে উঠে আসে। ওই সময় খাবারসহ অন্যান্য সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
এমভি রাজারহাট-সি জাহাজে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে কি না, তা দেখতে বৈঠকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একজন করে সদস্য রয়েছেন।
কমিটির সদস্যরা সরেজমিন জাহাজে কী কী সুবিধা আছে, তা দেখবেন। এ ছাড়া নিরাপত্তার সরঞ্জাম, নিবন্ধন সনদ, সার্ভে সনদ, নৌযানটি চলাচলের উপযুক্ততা এবং কোনো কারিগরি ত্রুটি আছে কি না, এসব দেখা হবে। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, ভারতে যাওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনের সময় এখন আকাশপথ ও সড়কপথের কথা উল্লেখ থাকে। নৌপথ শব্দটিও যাতে যুক্ত করা হয়, ভারতের কাছে সে অনুরোধ জানাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাহাজটিতে সব ধরনের সুবিধা আছে কি না, তা নিশ্চিত হয়ে অনুমোদন দেওয়া হবে।