চুরি ও নানা অপরাধে জরিত ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব,
নিউজ ডেস্ক,
র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন ধরণের অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। র্যাবের সৃষ্টিকাল থেকে অদ্যাবধি জঙ্গি, মাদক, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও প্রতারকচক্র গ্রেফতারে সদা তৎপর রয়েছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িত আসামীদের দ্রæততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে সাধারণ জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে র্যাব।
গত ০৯ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ রাতে যশোরের চৌগাছা হতে সৈয়দ আলী মন্ডল (৬৫) নামক এক ব্যক্তি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ হতে প্রবাস ফেরত তার ছেলেকে নেয়ার জন্য রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এসে নিখোঁজ হন। ভিকটিম এর পরিবার সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজাখুজি করে ভিকটিমকে না পেয়ে ভিকটিমের জামাতা রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। যার জিডি নং-১০২৭, তারিখ ১০ অক্টোবর ২০২৩। এছাড়াও ভিকটিমের পরিবার র্যাব-৪ এর নিকট ভিকটিমকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করেন। র্যাব উক্ত নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য গোয়েন্দা নজদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সন্ধ্যায় র্যাব-৩ এবং র্যাব-৪ এর একটি যৌথ আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসায় অভিযান পরিচালনা করে নিখোঁজ ও অপহৃত ভিকটিম সৈয়দ আলী মন্ডলকে উদ্ধার করে। এ সময় অপহরণের সাথে জড়িত ১। খোরশেদ আলম (৫২), কুমিল্লা ২। জুয়েল রানা মজুমদার (৪০), কুমিল্লা এবং ৩। মাসুম আহমেদ (৩৫), নারায়ণগঞ্জদের’কে গ্রেফতার করে। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমান স্বর্ণ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রসাধনী, অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রী যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা উক্ত অপহরণের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।
জানা যায় যে, ভিকটিম সৈয়দ আলীর ছেলে প্রবাসি নুরুন্নবী গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখ উন্নত জীবন যাপনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গমন করে। বিদেশে গমনের পর সেখানে ভালো চাকরি ও সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় একপর্যায়ে দেশে ফেরত আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় প্রবাসে এই চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ এবং তার সহযোগীরা নুরুন্নবীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাকে বাংলাদেশে আসার ফ্রি টিকেট দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্বর্ণালংকার এবং একটি লাগেজে বেশকিছু দামী কসমেটিক্স পণ্য, ইলেকট্রনিকস আইটেম, চকলেট ইত্যাদি বাংলাদেশে নিয়ে এসে গ্রেফতারকৃত খোরশেদ এর নিকট হস্তান্তর করতে হবে বলে শর্ত দেয়। প্রবাসি নুরুন্নবী তাদের দেয়া শর্তে রাজী হয় এবং ০৯ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ রাতে ঢাকায় আসবে বলে তার পরিবারকে জানায়। প্রবাসি নুরুন্নবীর পিতা ভিকটিম সৈয়দ আলী ০৯ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ রাতে প্রবাস ফেরত ছেলেকে নেয়ার জন্য ঢাকায় আসলে চক্রের সদস্যরা তাদের পাঠানো পণ্য নিরাপদে পাওয়ার জন্য জামানত হিসেবে ভিকটিম সৈয়দ আলীকে কৌশলে রাজধানীর শান্তিনগরের একটি বাসায় নিয়ে জিম্মি করে রাখে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, এই চক্রটি বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসি আরো বেশকয়েকজন দুস্কৃতিকারী বাংলাদেশিদের পরস্পর যোগসাজসে প্রবাস ফেরত বিভিন্ন যাত্রীদের মাধ্যমে বিগত ৫/৬ বছর যাবৎ কৌশলে অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মূল্যবান পণ্য দেশে এনে বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করে আসছিল। এই চক্রটির অন্যতম মূলহোতা আবু ইউসুফ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসি। দেশে ও বিদেশে এই চক্রটির প্রায় ১২-১৫ জন সদস্য রয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রবাসিদের গ্রæপসহ বিভিন্ন স্থানে ফ্রি টিকিটে বাংলাদেশে আসার প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। উক্ত বিজ্ঞাপন দেখে যে সকল প্রবাসি ফ্রি টিকিটে দেশে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করে তাদেরকে চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ ফ্রি টিকেট দেয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক প্রবাসি ব্যক্তির নিকট স্বর্ণ, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন প্রকারের দামী প্রসাধনী ও অন্যান্য মূল্যবান পণ্যের ২৫ থেকে ৩০ কেজির ওজনের একটি লাগেজ প্রদান করে। প্রতিটি লাগেজে আনুমানিক ১০-১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের পণ্য থাকে বলে জানা যায়। এছাড়াও যারা ফ্রি টিকেটে দেশে আসতে চায় প্রথমে তাদের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক নথিপত্র চক্রটি নিজেদের জিম্মায় নেয় এবং প্রকৃতপক্ষে তারা দেশে আসবেন কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে বাংলাদেশে থাকা চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে টার্গেটকৃত প্রবাসির আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করে প্রবাসি ব্যক্তির দেশে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, প্রবাসি ব্যক্তি দেশে আসার আগের দিন চক্রের সদস্যরা কৌশলে প্রবাসি ব্যক্তিকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয় এবং একটি লাগেজে করে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন প্রকার দামী ইলেকট্রনিক্স আইটেম এবং প্রসাধনী সামগ্রী প্রদান করে যেগুলো বাংলাদেশে থাকা চক্রের অপর সদস্যদের নিকট হস্তান্তর করতে হয়। একইসাথে যাদেরকে ফ্রি টিকেট দেয়া হয় তাদের আত্মীয় স্বজনকে বাংলাদেশের প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়। প্রবাসির আত্মীয়-স্বজন তাদের সাথে যোগাযোগ করলে কৌশলে চক্রটি তাদেরকেও ঢাকায় এনে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে তাদের পরিচিত ও আগে থেকে নির্ধারিত বাসায় নিয়ে জিম্মি করে রাখে। প্রবাসি ব্যক্তির ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করার কয়েক ঘন্টা পূর্বে চক্রের কয়েকজন সদস্য বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকে। পরবর্তীতে প্রবাসি যাত্রী বাংলাদেশে পৌঁছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা মালামালপূর্ণ লাগেজ চক্রের সদস্যদের নিকট যথাযথভাবে হস্তান্তর করলেই জিম্মিকৃত আত্মীয়দের ছেড়ে দেয়া হয়। চক্রটি নিজেদের গোপনীয়তার স্বার্থে ২-৩ মাসের মধ্যেই ভাড়াকৃত বাসা পরিবর্তন করে থাকে। উল্লেখ্য যে, যেই ভাড়াকৃত বাসা হতে ভিকটিম সৈয়দ আলীকে উদ্ধার করা হয় সেই বাসাটিও ২ মাস পূর্বে গ্রেফতারকৃতরা ভাড়া হিসেবে নিয়েছিল।
গ্রেফতারকৃতরা জানায় প্রবাসি যাত্রীদের মাধ্যমে কৌশলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান পণ্য সামগ্রী গুলিস্তান ও পল্টনসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে অবৈধভাবে বিক্রি করে থাকে। বিদেশ থেকে নিয়ে আসা একটি লাগেজের পণ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন মার্কেটে ১৫-২০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানায়। পরবর্তীতে বিক্রয়কৃত মালামালের লভ্যাংশের একটি অংশ গ্রেফতারকৃত খোরশেদ নিজে গ্রহণ করে, কিছু অংশ যারা বিভিন্ন দায়িত্বে থাকে তাদেরকে বন্টন করে দেওয়া হয় এবং সর্বশেষ পণ্যের দামসহ লভ্যাংশের একটি বড় অংশ হুন্ডি বা বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে মধ্যপ্রাচ্যে থাকা চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ এর নিকট প্রেরণ করে। তারা এ যাবত কৌশলে অবৈধভাবে বিপুল পরিমান মূল্যবান পণ্য বাংলাদেশে এনে সরকারের বিপুল পরিমান শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত খোরশেদ ২০০৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গমন করে এবং এবছর দেশে ফেরত এসে বাংলাদেশ অংশে এই চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করতো। সে প্রবাসি ব্যক্তিদের আত্মীয় স্বজনকে অপহরণ করে তার ভাড়াকৃত বাসায় জিম্মি করে রাখতো। প্রবাসি ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ, প্রবাসি ব্যক্তির বিদেশ থেকে দেশে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করা, কৌশলে অপহরণ করানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে থাকা চক্রের মূলহোতা আবু ইউসুফ এর সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখত।
গ্রেফতারকৃত জুয়েল অবৈধভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা কসমেটিক্সের ব্যবসা করতো। ইতোপূর্বে তার গাজীপুরে সাইকেল ও রিক্সার পার্টস এর ব্যবসা ছিল। সে প্রবাসি ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনকে অপহরণ এবং বিদেশ থেকে নিয়ে আসা পণ্যসমূহ রাখার জন্য বাসা খোঁজ করা ও বাসা ভাড়া নেয়ার কাজ করতো। এছাড়াও অবৈধভাবে আনা মালামাল বিভিন্ন স্থানে পৌছানো ও বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে বের করার কাজও করতো। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির বিমানবন্দর থানা ও ওয়ারি থানায় একই অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত মাসুম গ্রেফতারকৃত জুয়েলের কসমেটিক্সের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতো। পূর্বে সে ঢাকায় প্রাইভেট কার চালানোর পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।